মারাত্মক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলছেন
ভার্জিনিয়া একজন যিহোবার সাক্ষি আর তার লক্ড-ইন সিনড্রোম নামের এক অসুখ হয়। এই অসুখে তার পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়। যদিও তিনি শুনতে পেতেন, দেখতে পেতেন, চোখ খোলা-বন্ধ করতে পারতেন আর মাথাটা একটু নাড়াতে পারতেন, তবে তিনি কথা বলতে পারতেন না, এমনকী খেতেও পারতেন না। একটা সময় ছিল, যখন তিনি সুস্থ ও সবল ছিলেন। কিন্তু, ১৯৯৭ সালে একদিন সকাল বেলা তিনি তার মাথার পিছনে এক তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। সেই ব্যথা কমছিল না বলে তার স্বামী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সে-দিন সন্ধ্যায় ভার্জিনিয়া কোমায় চলে যান। দুই সপ্তাহ পরে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তার জ্ঞান ফিরে আসে। তিনি প্যারালাইজড অবস্থায় ছিলেন এবং কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নিচ্ছিলেন। বেশ কয়েক দিন তিনি কিছুই মনে করতে পারছিলেন না। তিনি এটাও মনে করতে পারছিলেন না যে, তিনি কে।
এরপর কী হয়, তা ভার্জিনিয়া নিজেই বলেন: “ধীরে ধীরে আমার স্মৃতি ফিরে আসে। আমি অবিরত প্রার্থনা করেছি। আমি মারা যেতে চাইনি আর আমার ছোট্ট ছেলেকেও মা-হারা করতে চাইনি। আমার মনের শক্তি ধরে রাখার জন্য আমি যত বেশি সম্ভব বাইবেলের পদ মনে করার চেষ্টা করেছি।
“ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে বের হয়ে আসার পর আমাকে ছয় মাস ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে এবং একটা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে রাখা হয়। এরপর ডাক্তাররা আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এত কিছুর পরেও আমি সম্পূর্ণভাবে প্যারালাইসড ছিলাম আর সমস্ত কাজ করার জন্য আমার অন্যের সাহায্যের দরকার হচ্ছিল। আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। আমার নিজেকে মূল্যহীন বলে মনে হচ্ছিল। আমি কারো জন্যই কিছু করতে পারছিলাম না, না যিহোবার জন্য, না অন্য কারো জন্য। এগুলো ছাড়াও আমি এটা নিয়ে খুব চিন্তা করতাম যে, আমার ছেলের এখন কী হবে!
“আমি অন্যান্য সাক্ষি ভাই-বোনদের অভিজ্ঞতা পড়তে শুরু করি, যারা আমার মতো মারাত্মক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আর আমি এটা জেনে অবাক হয়ে যাই যে, এমন পরিস্থিতিতে থাকার পরও তারা যিহোবার জন্য কত কিছু করতে পেরেছে। তাদের অভিজ্ঞতা পড়ে আমি উৎসাহ পাই আর আমার এই পরিস্থিতিতে আমি কী করতে পারি, সেটার উপর মনোযোগ দিতে শুরু করি। আমি চিন্তা করি, অসুস্থ হওয়ার আগে আধ্যাত্মিক কাজ করার জন্য আমার হাতে খুব একটা সময় থাকত না। কিন্তু, এখন তো আমার সময়ই সময়, কোনো ব্যস্ততা নেই। তাই, আমি হতাশায় ডুবে না গিয়ে যিহোবার প্রতি আমার ভালোবাসা কীভাবে দেখাতে পারি, সেটার প্রতি মনোযোগ দিই।
“আমি কম্পিউটার চালাতে শিখি। সেটাতে এমন একটা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা আমার মাথার নড়াচড়ার উপর ভিত্তি করে টাইপ করতে পারে। এই পদ্ধতিতে টাইপ করা যদিও বেশ ক্লান্তিকর, তবে এই টেকনোলজি ব্যবহার করে আমি অন্ততপক্ষে বাইবেল অধ্যয়ন করতে পারি আর আমি যা বিশ্বাস করি, তা অন্যদের কাছে চিঠি লিখে বা ই-মেইল পাঠিয়েও জানাতে পারি। আমার আশেপাশের লোকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার কাছে একটা বোর্ড আছে, যেটাতে বিভিন্ন বর্ণ আলাদা আলাদা করে লেখা আছে। যে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, সে সেই বর্ণগুলো আঙুল দিয়ে একটা একটা করে দেখায়। যখন সে ভুল বর্ণে আঙুল দেয়, তখন আমি চোখ বড়ো করে তাকাই। আর যখন সে সঠিক বর্ণে আঙুল দেয়, তখন আমি চোখ বন্ধ করি। এভাবে বার বার বর্ণ বাছাই করে করে আমরা শব্দ এবং বাক্য তৈরি করি। যে-বোনেরা আমাকে অনেক লম্বা সময় ধরে সাহায্য করছে, তারা এমনই এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছে যে, আমি পুরো কথা শেষ করার আগেই বুঝে ফেলে যে, আমি কী বলতে চাচ্ছি। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি যেটা বলতে চাইনি, তারা সেই শব্দটা বাছাই করে। তখন সেটা নিয়ে আমরা হাসি।
“আমি মণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরেও অনেক খুশি। আমি সবসময় মণ্ডলীর সভাগুলোতে যোগ দিয়ে এসেছি, শুরুতে টেলিফোনের মাধ্যমে আর এখন ভিডিও কলের মাধ্যমে। সভার প্রশ্ন-উত্তর আলোচনা পর্বের জন্য আমি আমার মন্তব্যগুলো আগে থেকে টাইপ করে রাখি আর সভার সময়ে কেউ একজন সেটা পড়ে দেয়। এ ছাড়া, কয়েক জন সাক্ষি ভাই-বোনের সঙ্গে আমি প্রতি মাসে JW ব্রডকাস্টিং দেখি। a
“লক্ড-ইন সিনড্রোম নামের এই অসুখটা নিয়ে আমি ২৩ বছর ধরে বেঁচে আছি। মাঝে মাঝে আমার খুব খারাপ লাগে, কিন্তু সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি প্রার্থনা করি, ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটাই আর যিহোবার কাজে ব্যস্ত থাকি। ভাই-বোনদের সাহায্য নিয়ে আমি এমনকী ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সহায়ক অগ্রগামী হিসেবে কাজ করছি। এভাবে আমি আমার ছেলে আলেসান্দ্রোর জন্যও ভালো উদাহরণ দেখাতে চেষ্টা করেছি। এখন আমার ছেলে বিবাহিত আর মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করছে। সে ও তার স্ত্রী একসঙ্গে নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবেও কাজ করছে।
“পরমদেশে আমি কী কী করব, সেগুলো নিয়ে আমি প্রায়ই কল্পনা করি। সবচেয়ে প্রথমে আমি যেটা করতে চাই সেটা হল, নিজের গলার স্বর ব্যবহার করে আমি অন্যদের কাছে যিহোবা সম্বন্ধে বলতে চাই। আমি সুন্দর পরিবেশে হাঁটতে চাই যেখানে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে আর প্রকৃতি উপভোগ করতে চাই। যেহেতু গত ২৩ বছর ধরে আমি একটা নলের সাহায্যে তরল খাবার খাচ্ছি, তাই আমার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যে, আমি গাছ থেকে নিজ হাতে একটা আপেল ছিঁড়ে খাব। আর একজন ইটালিয়ান হওয়ার কারণে আমি আমার পছন্দের সব ধরনের ইটালিয়ান খাবার রান্না করতে চাই ও খেতে চাই আর সেগুলোর মধ্যে পিৎজার কথা তো না বললেই নয়।
“ভবিষ্যতে যিহোবা যা-কিছু করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেই ‘প্রত্যাশা’ আমার চিন্তাভাবনাকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে। (১ থিষলনীকীয় ৫:৮) এখন আমি শারীরিকভাবে অক্ষম, কিন্তু নিজেকে নতুন জগতে কল্পনা করে আমি অনেক আনন্দ পাই, কারণ আমি জানি সেই সময় আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠব। যিহোবা তাঁর রাজ্যের মাধ্যমে যে-‘প্রকৃত জীবন’ দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা উপভোগ করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছি।”—১ তীমথিয় ৬:১৯; মথি ৬:৯, ১০.
a jw.org ওয়েবসাইটে JW ব্রডকাস্টিং-এর লিংক পাওয়া যাবে।