সাক্ষাৎকার | রাজেশ ক্যালারিয়া
একজন ব্রেন প্যাথলজিস্ট তার বিশ্বাস সম্বন্ধে বলেন
অধ্যাপক রাজেশ ক্যালারিয়া ইংল্যান্ডের নিউকাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি একসময় বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু পরে, তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেন। সজাগ হোন! পত্রিকা তাকে তার গবেষণা ও বিশ্বাস সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল।
আপনার ধর্মীয় পটভূমি সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন।
আমার বাবার জন্ম ভারতে আর আমার মা যদিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিন্তু তার জন্ম উগান্ডায়। তারা প্রধানত হিন্দু রীতিনীতি অনুযায়ী জীবনযাপন করতেন। আমরা তিন ভাই আর তাদের মধ্যে আমি হলাম দ্বিতীয়। আমরা কেনিয়ার নাইরোবিতে থাকতাম। আমাদের এলাকায় অন্যান্য হিন্দুরাও থাকত।
কেন আপনি বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন?
আমি খুব পশুপাখি ভালোবাসতাম এবং প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে চমৎকার বন্য জীবজন্তু দেখার জন্য বেরিয়ে পড়তাম আর বনে তাঁবু খাটিয়ে থাকতাম। প্রথমে আমি একজন পশু চিকিৎসক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাইরোবির এক টেকনিক্যাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর প্যাথলজি নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য আমি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অভ্ লন্ডনে চলে যাই। পরে, আমি মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হই।
আপনার গবেষণা কি আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল?
হ্যাঁ। আমি বিজ্ঞান নিয়ে যত বেশি গবেষণা করি, তত আমার পক্ষে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি ও রীতিনীতি বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে, যেমন পশুপাখি ও মূর্তি উপাসনা করা।
কেন আপনি বিবর্তনবাদের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন?
ছেলেবেলায় আমার আশেপাশের লোকেরা বিশ্বাস করত, মানব বিবর্তন আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল আর প্রায়ই আমরা স্কুলে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। এ ছাড়া, আমার শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ছাত্রদের মধ্যে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে, সমস্ত সম্মাননীয় বিজ্ঞানীই বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন।
একসময় আপনি জীবনের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্নকে পুনর্বিবেচনা করে দেখলেন। কেন?
আমি কিছু বছর জীববিদ্যা ও দৈহিক গঠনতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। সেই সময়, আমার এক সহছাত্র যিহোবার সাক্ষিদের কাছ থেকে বাইবেল সম্বন্ধে যা শিখছিলেন, তা আমাকে জানান। আমি কৌতূহলী হয়ে পড়ি। আর তাই, যিহোবার সাক্ষিরা যখন নাইরোবিতে আমাদের কলেজ হলে সম্মেলনের আয়োজন করে, তখন আমি সেখানে যোগ দিই। পরে, দু-জন মিশনারি সাক্ষি আমার কাছে বাইবেলের কিছু শিক্ষা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন। তারা বিশ্বাস করতেন, একজন মহান নকশাকার রয়েছেন, যাঁর কাছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর রয়েছে আর তাদের এই বিশ্বাস আমার কাছে পৌরাণিক কাহিনি বলে মনে হয়নি। আমার কাছে বিষয়টা খুবই যুক্তিসংগত বলে মনে হয়েছিল।
চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান কি আপনাকে সৃষ্টিতে বিশ্বাস করায় বাধা দিয়েছিল?
আসলে এর ঠিক বিপরীতটাই ঘটেছিল! দৈহিক গঠনতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করার সময় আমি দেখতে পাই, জীবিত প্রাণীরা খুবই সুপরিকল্পিত ও জটিলভাবে সৃষ্ট হয়েছে। এলোমেলো পদ্ধতিতে এই ধরনের উচ্চমানের প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানো হয়েছে, তা মেনে নেওয়া আমার কাছে বোকামি বলে মনে হয়।
আপনি কি আমাদের একটা উদাহরণ দিতে পারেন?
আমি ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছি আর এই অসাধারণ অঙ্গ সবসময় আমাকে অভিভূত করে। এই মস্তিষ্কের মাধ্যমে আমরা চিন্তা করি ও কোনো কিছু স্মরণে রাখি আর এটা আমাদের শরীরের বহু কাজকর্মের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এ ছাড়া, এটা আমাদের শরীরের অনেক ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্রস্থল, যা দেহের ভিতর ও বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন তথ্যের অর্থ ব্যাখ্যা করে।
আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, সেটার জন্য প্রধানত এর জটিল রসায়ন ও স্নায়ুকোষ অর্থাৎ মস্তিষ্কের প্রাথমিক কোষ দিয়ে গঠিত জটিল স্নায়ুতন্ত্রই দায়ী। মানব মস্তিষ্কে কোটি কোটি স্নায়ুকোষ রয়েছে, যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে আ্যক্সন নামক লম্বা সূক্ষ্ম তন্তু দ্বারা সংযোগ রক্ষা করে। একটা স্নায়ুকোষ এগুলোর মাধ্যমে অন্যান্য স্নায়ুকোষের ডেনড্রাইট নামক শাখা-প্রশাখার সঙ্গে হাজার হাজার সংযোগস্থল তৈরি করতে পারে। ফলে, মস্তিষ্কে অগণিত সংযোগস্থল রয়েছে! এর চেয়েও অবাক করার মতো বিষয় হল, ঘন জঙ্গলের মতো এই স্নায়ুকোষ ও ডেনড্রাইটগুলো বিশৃঙ্খলভাবে নয় বরং সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো রয়েছে। এটা এক আশ্চর্য ‘ওয়্যারিং’-এর কাজ।
দয়া করে একটু ব্যাখ্যা করুন।
গর্ভে থাকাকালীন আর সেইসঙ্গে জন্মের পর শিশুর স্নায়ুকোষের এই ওয়্যারিং-এর কাজ খুব সুষ্ঠভাবে চলতে থাকে। স্নায়ুকোষগুলো কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে থাকা অন্যান্য স্নায়ুকোষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সূক্ষ্ম তন্তু প্রেরণ করে আর কোষীয় পর্যায়ে এই কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বের অর্থ আসলে খুবই বিশাল। একটা তন্তুর লক্ষ্য হয়তো শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট কোষই নয় বরং সেই কোষের একটা নির্দিষ্ট অংশে সংযোগ স্থাপন করা।
একটা স্নায়ুকোষ থেকে যখন একটা নতুন তন্তু উৎপন্ন হয়, তখন এটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত বিভিন্ন রাসায়নিক সংকেত দ্বারা পরিচালিত হয়, যেগুলো হয়তো এটাকে বলে ‘থামো’ ‘চলো’ কিংবা ‘ঘোরো।’ স্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়া এই বৃদ্ধিরত তন্তু শীঘ্র লক্ষ্য হারিয়ে ফেলতে পারে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া চমৎকারভাবে সংগঠিত থাকে, যেটা আমাদের ডিএনএ-তে লিখিত নির্দেশনা অনুযায়ী শুরু হয়।
এটা জানা সত্ত্বেও, আমরা মস্তিষ্কের গঠন ও কাজ এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি আর সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কীভাবে এটা স্মরণ করতে পারে, অনুভূতি বুঝতে পারে ও চিন্তা করতে পারে। মস্তিষ্ক কত ভালোভাবে কাজ করছে ও কত সুন্দরভাবে গঠিত, সেই বিষয়গুলো উল্লেখ না করলেও শুধু মস্তিষ্ক কাজ করছে, আমার কাছে এই তথ্যটাই যথেষ্ট, যা আমাকে ইঙ্গিত দেয় যে, আমাদের চেয়েও হাজার গুণ বুদ্ধিসম্পন্ন কেউ রয়েছেন।
কেন আপনি একজন যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন?
সাক্ষিরা আমাকে এই প্রমাণ দেখিয়েছিল, বাইবেল ঈশ্বরের বাক্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাইবেল বিজ্ঞানের কোনো বই নয়, কিন্তু যখন এটি বিজ্ঞানের বিষয়ে কিছু জানায়, তখন তা সবসময় নির্ভুল। এ ছাড়া, বাইবেলে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। আর যারা এটির শিক্ষা কাজে লাগায়, তাদের জীবনধারা উন্নত হয়। আমার নিজের জীবনই সেটার একটা প্রমাণ। ১৯৭৩ সালে একজন যিহোবার সাক্ষি হওয়ার পর থেকে বাইবেল আমার জীবনের নির্দেশিকা হয়ে উঠেছে। ফল স্বরূপ, আমার জীবন সত্যিই সন্তোষজনক ও উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।